- প্রথম অধ্যায় (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পরিচিতি) – পরিচিতি, গ্লোবাল ভিলেজ ও ডিজিটাল যুগ
আসসালামু আলাইকুম। পরাবৃত্তের ষষ্ঠ শ্রেণির তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সিরিজে স্বাগত জানাচ্ছি।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
প্রযুক্তি শব্দটা অনেক বিস্তৃত। আমাদের জ্ঞান বা প্রাকৃতিক কিছুকে যখন আমরা ব্যবহারিক কাজে লাগানোর জন্য কোন যন্ত্র বা কৌশল উদ্ভাবন করি তখন সেটাকে বলা হয় প্রযুক্তি। পেনসিল, কলম থেকে শুরু করে মহাকাশে পাঠানো স্পেসপ্রোব সবকিছু এই শব্দটার মধ্যে আসবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বলতে আমরা বোঝাই তথ্য সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ, ব্যবহার ও আদান-প্রদানের ডিজিটাল ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ডিভাইস (কম্পিউটার বা মোবাইল), সফটওয়্যার (ডকুমেন্ট এডিটর, মেসেঞ্জার), নেটওয়ার্ক (ইন্টারনেট, লোকাল নেটওয়ার্ক), প্রোগ্রামিং ভাষা প্রভৃতি।
তথ্যের বিভিন্ন রূপ থাকতে পারে- টেক্সট, ছবি, অডিও, ভিডিও প্রভৃতি। কম্পিউটার বা মোবাইলে আমরা যা কিছু নিয়ে কাজ করি, সবই আসলে তথ্যের বিভিন্ন ধরণ। তথ্য প্রযুক্তি শব্দটা সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও ব্যবহারকে উপস্থাপন করে।
আমরা এর সাথে যোগাযোগ শব্দটা সংযোজন করছি- কেননা তথ্যের আদান-প্রদান বা বিনিময় বর্তমান সময়ে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। হাতের মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে প্রায় যেকোন বিষয়ে আমরা জানতে পারছি। টেলিভিশন বা রেডিওতে খবর দেখতে বা শুনতে পারছি। দূর-দূরান্তের সবকিছু পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের ঘর পর্যন্ত। এই সবকিছু সম্ভব হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে।
গ্লোবাল ভিলেজ
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দূর-দূরান্তের যে কারো সাথে মুহুর্তের মধ্যে যোগাযোগ করাকে সম্ভবপর করেছে। এজন্য চিঠি পাঠিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষারও আর প্রয়োজন হয় না। মোবাইল নাম্বার বা ইমেইল বা সোশ্যাল মিডিয়া যেকোন মাধ্যম জানা থাকলে এই মুহুর্তেই পৃথিবীর যে কারো সাথে তুমি কথা বলতে পারো, ভিডিও কল করতে পারো, বার্তা বা ছবি আদান-প্রদান পারো।
বাস্তবে দূরে থাকলেও ভার্চুয়ালি সবাই যেন আমরা একই গ্রামে থাকার মত কাছাকাছি আছি, এই ধারণাটাকেই বলা হয় গ্লোবাল ভিলেজ বা বৈশ্বিক গ্রাম। অবশ্য বাংলা ভাষায় বৈশ্বিক গ্রাম থেকে বিশ্বগ্রাম শব্দটা বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে।
ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স ও ডিজিটাল যুগ
ডিজিট মানে অঙ্ক, ডিজিটাল মানে অঙ্ক সম্পর্কিত। কম্পিউটার, মোবাইল, ডিজিটাল ক্যামেরা, ই-বুক রিডারের মত ডিভাইসগুলো বৈদ্যুতিক বিভবের কম-বেশিকে 0 ও 1 হিসেবে শনাক্ত করে এর ভিত্তিতে সকল তথ্যকে সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে। এজন্য এই ডিভাইসগুলোকে ডিজিটাল ডিভাইস বলা হয়।
বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অগ্রগতি সম্ভবপর হয়েছে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের বিকাশের মধ্য দিয়ে। এজন্য বর্তমান যুগকে অনেক সময় ডিজিটাল যুগ বলা হয়।
ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে এই লেখাটা তোমাকে কিছুটা ধারণা দিবে: ডিজিটাল ও এনালগ: পার্থক্য কী?
ডিজিটাল বাংলাদেশ
শুধু তাই নয়, আমরা বলি আমাদের প্রিয় দেশটাকেই আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করে ফেলব—যার অর্থ একেবারে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের সব মানুষের জীবন সহজ করে দেবো, সবার দুঃখ-কষ্ট দূর করে জীবনকে আনন্দময় করে দেবো।
ওপরের লেখাটুকু সরাসরি তোমাদের বই থেকে নেয়া হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর করার প্রকল্প ছিলো আওয়ামী লীগ সরকারের। আরো ৪ বছর চলে গেলো তারপর। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ কি আসলে ডিজিটাল হয়েছে?
ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা হলো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিটি ক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।
আমরা বাস্তব চিত্র দেখি। বর্তমানে স্মার্টফোন, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সবার হাতে হাতে পৌঁছে গেছে। সরাসরি ক্লাসের বদলে অনলাইনে ক্লাস করছি আমরা। মেট্রোরেলের মত ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর অত্যাধুনিক যানবাহন হচ্ছে। টাকার বদলে ডিজিটাল ক্যাশ, মোবাইল ব্যাঙ্কিং ব্যবহারে অভ্যস্থ হচ্ছি। বিপরীত দিকে দেখলে এখনো বিভিন্ন সরকারী সেবায় ভোগান্তি আগের মতই রয়েছে। আন্তর্জাতিক পেমেন্টসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি বা সেবাগুলো বাংলাদেশে আসেনি। সব মিলিয়ে বলা যায় কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও সত্য যে অনেকাংশেই বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে।
কিন্তু দ্বিতীয় লাইন, অর্থাৎ ‘বাংলাদেশের সব মানুষের জীবন সহজ করে দেবো, সবার দুঃখ-কষ্ট দূর করে জীবনকে আনন্দময় করে দেবো’, এটা কতটুকু বাস্তব হয়েছে? আসলেই কি প্রযুক্তির ব্যবহার জীবনকে সহজ, আনন্দময় ও সবার দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পেরেছে? যদি না পেরে থাকে, তবে শুধুমাত্র আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কি সত্যই জীবনকে সুন্দর করতে পারে?
বদলে দেয়ার বিপ্লব
ইন্টারনেট ও এরকম নেটওয়ার্কগুলো মিলে সবার মধ্যে তথ্য দেয়া-নেয়ার বৈশ্বিক যে কাঠামো গড়ে উঠেছে, তাকে বলা হচ্ছে ইনফরমেশন সুপারহাইওয়ে। বাস, ট্রাকের মত যানবাহনগুলো চালানোর জন্য যেমন হাইওয়ে আছে, সেরকম তথ্য চলাচলে বিস্তৃত একটা হাইওয়ে।
একটা সময় টিভি-পত্রিকা মিডিয়াগুলোতে সরকারিভাবে দখল রেখে চরম পরিস্থিতির মধ্যেও সবকিছু শান্ত-সুন্দর দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা সহজ ছিলো। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তা কঠিন করে দিয়েছে। একজন ক্ষমতাশালী মানুষ আর একজন সাধারণ মানুষকে তথ্যপ্রাপ্তিতে অনেকটা সমতায় নিয়ে আসছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। প্রযুক্তির এই ব্যবহারের ফলে সম্ভব হচ্ছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
তথ্যের এই বিনিময় কতটা শক্তিশালী তার উদাহরণ আমরা সর্বত্র দেখতে পাই। জুলাই আন্দোলনের সময়ের কথা মনে আছে? আমরা দেখেছি প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রোফাইল লাল করার মত কার্যক্রমগুলো কীভাবে জনমত তৈরি করেছে। কীভাবে সবাইকে এক হতে সাহায্য করেছে। যেকারণে সরকার ইন্টারনেট বন্ধও রেখে দিয়েছিলো দীর্ঘ সময়।
চিন্তার খোরাক
আমাদের হতে হবে সচেতন। প্রযুক্তিকে আমরা দূরে ঠেলে দিবো না। কিন্তু গ্রহণ করব সচেতনতার সাথে। আর সবসময় খোলা রাখবো চিন্তার দুয়ার।
কে বলেছিলেন জানি না, খুব সুন্দর একটা কথা- তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলো এই মুহুর্তে তোমার সামনে যিনি আছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো এই মুহুর্তে তোমার হাতে যে কাজ আছে।
যখন দূর-দূরান্তের মানুষদের সাথে আমাদের দূরত্ব কমছে, পৃথিবীর সবকিছু এসে পৌঁছেছে আমাদের হাতের মুঠোয়- তখন কেমন যেন আমাদের সবার মাঝে এক অদ্ভুত দূরত্বের দেয়াল তৈরি হচ্ছে। পরিবারের সবাই একই সাথে, অথচ সবাই নিজের মত মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত- যেন সবাই সবার থেকে অনেক অনেক দূরে। কেমন যেন আমরা পুরো পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে আমাদের কাছের বন্ধু, পরিবার আর সমাজ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি।
প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক কাজকে সহজ করেছে। একসময়ে অসম্ভব মনে হত এমন অনেক কাজকে সম্ভব করেছে। কিন্তু মানুষের জীবনে প্রযুক্তির ব্যবহার শান্তি আনতে পেরেছে কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর যেন অমীমাংসিত থেকে গেছে। বিশ্বের আনাচে-কানাচে এখনো প্রতিনিয়ত শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত হচ্ছে অজস্র মানুষ।
শুধু প্রযুক্তির উন্নতি বা প্রযুক্তিকে বরণ করে নেয়া যথেষ্ট না। বরং প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে যথাযথভাবে, ভালোর জন্য। বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অন্তত শক্তিশালী অস্ত্রের মত। এর অসাবধান ব্যবহারও ততটাই বিপজ্জনক, আবার একে দূরে ঠেলে দেয়া কখনো কখনো বোকামি।
অন্যদিকে রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস নিয়ে অজ্ঞ হলে নিছক প্রযুক্তির জ্ঞান কাজে আসবে না। যেমন জুলাইয়ে সরকার যখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিলো তখন আমরা অনুভব করেছিলাম রাজনৈতিক ক্ষমতার সামনে প্রযুক্তির অসহায়ত্ব।
আমাদের চিন্তা করতে হবে। শুধু দৃশ্যমান উন্নতি না, আমাদের কাজ করতে হবে সত্যিকার অর্থে শান্তির জন্য। পরিবর্তন আমাদের হাত ধরে আসবে, ইন শা আল্লাহ।