- প্রথম অধ্যায় (নিম্নশ্রেণির জীব) – শ্রেণিবিন্যাস, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া
আসসালামু আলাইকুম। পরাবৃত্তের সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান সিরিজে স্বাগত জানাচ্ছি।
আমাদের প্রথম অধ্যায় হলো নিম্নশ্রেণির জীব। প্রথমেই প্রশ্ন চলে আসে কীসের ভিত্তিতে আমরা কোন জীবকে নিম্নশ্রেণির বা উচ্চশ্রেণির বলছি? সাধারণভাবে বলছি, কোন জীবের বৈশিষ্ট্য মানুষের যত কাছাকাছি, আমরা সেটাকে তত উচ্চশ্রেণির মনে করি। আর আরেকটু যথাযথভাবে বললে যেসকল জীবের গঠন সরল- যেমন অকোষীয়, এককোষী, অথবা বহুকোষী হলে টিস্যু, তন্ত্র, অঙ্গ প্রভৃতি গঠন হয় না, তাদেরকে আমরা নিম্নশ্রেণির জীব বিবেচনা করি।
পূর্ব আলোচনা: জীবজগতের শ্রেণিবিন্যাস
আমার একজন স্যার বলতেন পড়াশোনা শুরু করতে হয় সবসময় জানা জায়গা থেকে। এজন্য সপ্তম শ্রেণির পড়া যদি ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ার সাথে মিলিয়ে নিতে পারি, তাহলে সুবিধাজনক। কিন্তু একটা ছোট্ট সমস্যা হলো ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের বই আর ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের বইয়ের মধ্যে বেশ বড় রকম পার্থক্য আছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে যেহেতু তোমরা আগের শিক্ষাক্রমের বই পড়েছ, তাই বর্তমান সপ্তম শ্রেণির বইয়ের সাথে আগের জ্ঞানকে মিলানো একটু কঠিন। এজন্য আমরা কিছুটা পূর্ব আলোচনা থেকে আসছি।
জীবন বলতে আমরা কী বুঝি এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা বেশ কঠিন। কেননা মানুষ হিসেবে আমরা নিজের অস্তিত্বকে যেভাবে অনুভব করি, এখন পর্যন্ত গবেষণা অনুযায়ী নিম্নতর শ্রেণির জীবেদের ক্ষেত্রে তেমনটা না। যাইহোক, জীবনকে কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে চিহ্নিত করা হয়- পুষ্টি লাভ, বৃদ্ধি ও বিকাশ, শক্তির রূপান্তর ঘটানো, পরিবেশের প্রতি প্রতিক্রিয়া এবং অভিযোজন বা পরিবর্তিত পরিবেশে মানিয়ে নেয়া।
জীবদেহের গঠন ও কাজের একক কোষ। কিছু জীব শুধু একটা কোষ দিয়ে গঠিত, যেমন ব্যাকটেরিয়া। এদের বলা হয় এককোষী জীব। অন্যদিকে একাধিক কোষ আছে এমন জীবকে বলা হয় বহুকোষী জীব। যেমন মানবদেহ অসংখ্য কোষ দিয়ে গঠিত।
কোষের মধ্যে বিভিন্ন অংশ রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হলো নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রিকা। কিছু জীবের কেন্দ্রিকা সুগঠিত এবং ঝিল্লির মধ্যে আবদ্ধ। এধরণের কোষকে প্রকৃতকোষ বলে। অন্যদিকে কেন্দ্রিকা যদি সুগঠিত না হয়, তখন তাকে বলে আদিকোষ।
জীবজগতকে আদিকোষী (প্রোক্যারিওটা) ও প্রকৃতকোষী (ইউক্যারিওটা) এই দুটো অধিরাজ্য বা সুপার কিংডমে বিন্যস্ত করা হয়। প্রোক্যারিওটা অধিরাজ্যের মধ্যে একটি রাজ্য আছে, মনেরা। অন্যদিকে ইউক্যারিওটা অধিরাজ্যের মধ্যে প্রোটিস্টা, ফানজাই, প্লান্টি ও এ্যানিমেলিয়া চারটি রাজ্য আছে।

প্রসঙ্গত, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে ৬টি রাজ্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস উল্লেখ করা হয়েছিলো, যেখানে মনেরা রাজ্যের পরিবর্তে ইউব্যাকটেরিয়া ও আর্কিব্যাকটেরিয়া দুটি আলাদা রাজ্য ছিলো। মূলত জীবজগতকে বিভিন্নসময়ে অনেকে ভিন্নভিন্নভাবে শ্রেণিবিন্যাস করার চেষ্টা করেছেন, কখনো ৪ রাজ্যে, কখনো ৫ রাজ্যে, কখনো ৬ রাজ্যে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে।
প্লান্টি রাজ্যের অধীনে আছে উদ্ভিদজগৎ এবং এ্যানিমেলিয়া রাজ্যের অধীনে আছে প্রাণীজগৎ। ভাইরাস অকোষীয়, অর্থাৎ আদিকোষ বা প্রকৃতকোষ কোন ধরণের কোষ ভাইরাসের নেই। যেকারণে জীবজগতের শ্রেণিবিন্যাসে ভাইরাসকে কোন রাজ্যেই রাখা হয় না।
তবে নিম্নশ্রেণির জীব পড়ার সময়ে আমরা ভাইরাসকেও আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করব। সাথে মনেরা, প্রোটিস্টা, ফানজাই রাজ্যের জীবেরা অন্তর্ভুক্ত হবে। প্লান্টি রাজ্যের মধ্যে নিম্নশ্রেণির কিছু উদ্ভিদ যেমন কিছু শৈবাল বা মসও নিম্নশ্রেণির জীবের মধ্যে পড়ে।
নিম্নশ্রেণির জীব ও অণুজীব
ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, শৈবাল, অ্যামিবা ইত্যাদিকে নিম্নশ্রেণির জীব বলা হয়। এদের গঠন খুব সরল প্রকৃতির, উদ্ভিদ বা প্রাণীর মত বিভিন্ন টিস্যু, তন্ত্র, অঙ্গ গঠন হয় না। এর মধ্যে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও অ্যামিবাসহ অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া দেখা যায় না, তাদেরকে অণুজীব বলা হয়। কিছু কিছু শৈবাল ও ছত্রাকও অণুজীবের মধ্যে পড়ে।
অণুজীবের শ্রেণিবিন্যাস
অণুজীব জগৎকে কোষের গঠন অনুযায়ী তিনটি রাজ্যে বিভক্ত করা হয়-
রাজ্য ১: এক্যারিওটা বা অকোষীয় (উদাহরণ: ভাইরাস)
রাজ্য ২: ইউক্যারিওটা বা আদিকোষী (উদাহরণ: ব্যাকটেরিয়া)
রাজ্য ৩: প্রোক্যারিওটা বা প্রকৃতকোষী (উদাহরণ: শৈবাল, ছত্রাক ও প্রোটোজোয়া)
ভাইরাস (অকোষীয়)
ভাইরাস অকোষীয়। এরা এত ক্ষুদ্র যে সাধারণ আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রে এদের দেখা যায় না, ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। আমরা বলেছি যে জীবের শ্রেণিবিন্যাসে ভাইরাসকে রাখা হয় না, মূলত ভাইরাসকে জীব বা জড় কোনটাই পুরোপুরি বলা যায় না।
অন্য জীবিত জীবদেহ ছাড়া ভাইরাস জীবনের কোন লক্ষণ প্রকাশ করতে পারে না। ভাইরাস স্বাধীনভাবে বিপাক, শক্তি উৎপাদন, বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম না। কেবলমাত্র অন্য জীবদেহে ভাইরাসের আমিষ আবরণ ও নিউক্লিক এসিড একত্র হলে এরা জীবনের লক্ষণ প্রকাশ করে, যেমন সংখ্যাবৃদ্ধি ও প্রকরণ সৃষ্টি। একারণে ভাইরাস প্রকৃত পরজীবী।
ভাইরাস শুধুমাত্র আমিষ আবরণ ও নিউক্লিক এসিড (ডিএনএ বা আরএনএ) দিয়ে গঠিত। কোষপ্রাচীর, প্লাজমালেমা, সুসংগঠিত নিউক্লিয়াস, সাইটোপ্লাজম ইত্যাদি কিছুই এদের নেই। কোন কারণে আমিষ আবরণ থেকে নিউক্লিক এসিড বের হয়ে গেলে ভাইরাস জীবনের সব লক্ষণ হারিয়ে ফেলে।
ভাইরাস বিভিন্ন আকৃতির হতে পারে- গোলাকার, দন্ডাকার, ব্যাঙাচির ন্যায় ও পাউরুটি আকৃতির। ভাইরাসের একটি প্রকার হলো ব্যাকটেরিওফাজ। পাঠ্যবই থেকে নেয়া নিচের ছবিতে একটি ব্যাকটেরিওফাজ ভাইরাসের গঠন দেখানো হয়েছে, এটি ব্যাঙাচির ন্যায় গঠন।

ভাইরাসের উপকারিতা:
- রোগের টিকা তৈরি: বসন্ত, পোলিও ও প্লেগের টিকা ভাইরাস থেকে তৈরি হয়।
- জিন প্রকৌশল: জিন প্রকৌশলে ভাইরাস ব্যবহৃত হয়।
- রোগ থেকে রক্ষা: ব্যাকটেরিওফাজ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করার মাধ্যমে কিছু ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ থেকে পরোক্ষভাবে রক্ষা করে।
ভাইরাসের অপকারিতা:
- মানবদেহে রোগ সৃষ্টি: কোভিড-১৯ ভাইরাসসৃষ্ট রোগ। অন্যান্য রোগের মধ্যে ভাইরাস মানবদেহে বসন্ত, হাম, সর্দি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, জন্ডিস প্রভৃতি রোগ তৈরি করে।
- উদ্ভিদে রোগ সৃষ্টি: উদ্ভিদের বিভিন্ন রোগ যেমন: তামাকের মোজাইক রোগ, ধানের টুংরো রোগ ইত্যাদি সৃষ্টি করে।
ব্যাকটেরিয়া (আদিকোষী)
ব্যাকটেরিয়া আদিকোষী অর্থাৎ আদি নিউক্লিয়াসযুক্ত তথা কোষের নিউক্লিয়াস সুগঠিত না। এরা অসবুজ (অর্থাৎ ক্লোরোফিল নেই বা সালোকসংশ্লেষণে অক্ষম), এককোষী আণুবীক্ষণিক জীব।
ব্যাকটেরিয়া সর্বপ্রথম দেখতে পান ডাচ বিজ্ঞানী অ্যান্টনি ভন লিউয়েন হুক। তখনকার সময়ের ম্যাগনিফাইং গ্লাসকে উন্নত করার চেষ্টায় তিনি অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন, এবং তার আবিষ্কৃত যন্ত্রেই দেখতে পান পানির মধ্যে অসংখ্য অণুজীব লুকিয়ে আছে।
ব্যাকটেরিয়ার আকৃতি: ব্যাকটেরিয়া গোলাকার, দন্ডাকার, কমা আকার, প্যাঁচানো বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। দেহের আকৃতির ভিত্তিতে ব্যাকটেরিয়ার শ্রেণিবিন্যাস-
- কক্কাস: গোলাকৃতির। এরা এককভাবে অথবা দলবদ্ধভাবে থাকতে পারে, যেমন- নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া।
- ব্যাসিলাস: লম্বা দন্ডাকৃতির। উদাহরণ- ধনুষ্টঙ্কার, রক্তামাশয় রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া।
- কমা: বাঁকা দণ্ডের মতো আকৃতির। উদাহরণ- মানুষের কলেরা রোগের ব্যাকটেরিয়া।
- স্পাইরিলাম: স্পাইরাল বা প্যাচানো আকৃতির।

ব্যাকটেরিয়ার উপকারিতা:
- মৃত জীবদেহ ও আবর্জনা পচাতে সাহায্য করে।
- একমাত্র ব্যাকটেরিয়া-ই প্রকৃতি থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে।
- পাট থেকে আঁশ ছাড়াতে সাহায্য করে।
- দই তৈরিতে ব্যাকটেরিয়ার সাহায্য নিতে হয়।
- বিভিন্ন জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া থেকে তৈরি হয়।
- ব্যাকটেরিয়া জীন প্রকৌশলের মূল ভিত্তি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবের কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য পাওয়ার জন্য জীনগত পরিবর্তনের কাজে ব্যাকটেরিয়াকে ব্যবহার করা হয়।
ব্যাকটেরিয়ার অপকারিতা:
- মানবদেহে রোগ সৃষ্টি: ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে যক্ষ্মা, কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় প্রভৃতি রোগ সৃষ্টি করে।
- পচন ঘটানো: ব্যাকটেরিয়া খাদ্যদ্রব্য, ফলমূলের পচন ঘটায়।
- উদ্ভিদে রোগ সৃষ্টি: উদ্ভিদের বিভিন্ন রোগ যেমন: ধানের লিফ ব্লাইট, টমেটোর ক্যাংকার ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া ঘটায়।