আমাদের গল্পের শুরুটা কোথায়? বিজ্ঞান এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে। মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত সম্প্রসারণ হচ্ছে, সবকিছু দূর থেকে আরো দূরে যাচ্ছে। অতীত আমরা দেখতে পাই না- তবে যদি সবসময়ই এভাবে চলে এসে থাকে, তবে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগের একটা সময় ছিলো যখন সবকিছু এক বিন্দুতে ছিলো। তারপর বিগ ব্যাং, সম্প্রসারণের শুরু। ইলেকট্রন, কোয়ার্ক, ফোটন, এবং তারপর পরমাণু আর অণুর সৃষ্টি। এরপর গ্যালাক্সি, গ্রহ-নক্ষত্রদের জন্ম-মৃত্যুর চক্রের সূচনা। এই চক্রের মধ্যেই ৪.৫৪ বিলিয়ন বছর আগে জন্ম নেয় এক গ্রহ, পৃথিবী, আমাদের আবাস। যেখানে প্রাণের স্পন্দন আছে।

মহাবিশ্ব ও প্রাণের সৃষ্টি নিয়ে আল কুরআনে বলা হয়েছে, “অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, আকাশ আর যমীন এক সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে আলাদা করে দিলাম, আর প্রাণসম্পন্ন সব কিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ৩০]

আমাদের গল্পের শুরুটা কোথায় করা যায়? যখন অতীত নিয়ে আমাদের জানা খুব সামান্যই। টুকরো টুকরো কিছু নমুনা, ফসিল থেকে যতটুকু অনুমান করে নিতে পারি। তবে এটুকু মোটামুটি বলা যায় পৃথিবীর বুকে মানুষের বিচরণ খুব কম সময়ের না, বিশ লক্ষ বছর তো হবেই!

আমাদের প্রত্যেকের যখন আলাদা আলাদা গল্প আছে, তখন সব গল্পগুলো ঠিকই সেই সময়ে এসে মিশবে। যখন খুব সুস্পষ্টভাবে সময়টা আমরা বলতে পারবে না, এতটুকু বলাই যায় তার অনেক লক্ষ বছর আগে থেকেই মানুষ হাতিয়ার তৈরি, আগুন জ্বালানো, পোশাকের ব্যবহার করেছে।

প্রাচীন মানবসমাজ কেমন ছিলো? আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তারা মূলত ছিলো শিকারী ও সংগ্রাহক- অর্থাৎ তারা পশু শিকার করত, ফলমূল সংগ্রহ করত জীবনধারণের জন্য। আমরা ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে চলে আসবো ১০ হাজার খ্রিস্টপূর্বের সময়ে- যখন মানুষ কৃষিকাজের দিকে মনোযোগী হতে থাকে।

শিকারী বা সংগ্রাহক হিসেবে জীবনটা একরকম। ধরে রাখার মত কোন বাঁধন নেই, পরিযায়ী পাখির মত এ জায়গা থেকে ও জায়গা ঘুরে বেড়ানো। কৃষিকাজ শুরু করার পর মানুষ এক জায়গায় বসবাস করতে শুরু করে। বিশেষ করে নদী বা পানির উৎসের আশেপাশে, কারণ কৃষির জন্য পানির সহজলভ্যতা প্রয়োজন।

কৃষিকাজের আরেকটা দিক আছে, খাদ্যের উদ্বৃত্ত। যখন বাড়তি খাবার থাকবে, তখন সবার খাদ্যের সন্ধানের দরকার নেই, অন্যান্য পেশায় যাওয়া, ক্রয়-বিক্রয় প্রভৃতির সুযোগ তৈরি হয়। এভাবে শ্রমবণ্টন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা গড়ে ওঠে, সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতির বিকাশ হতে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে সরকারব্যবস্থা ও সভ্যতা গড়ে ওঠে।

আজকের দিনে বিভিন্ন দেশের মাঝে যে কৃত্রিম সীমারেখা তৈরি করে দেয়া হয়, তা অনেকাংশে বেশ নতুন ধারণা। এর অধিকাংশ গড়ে উঠছে গত দেড়শো বছরে, উনিশ-বিশ শতকের দিকে। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর সীমানা সাধারণত নদী কিংবা সাগরে এসে শেষ হত।

সর্বপ্রাচীন যে সভ্যতার কথা আমরা জানতে পারি, তা প্রায় ৬০০০ বছর আগের, সুমেরীয় সভ্যতা। ঠিক কোন মুহুর্তে কোন মানবগোষ্ঠী ‘সভ্যতা’য় পরিণত হবে এই প্রশ্নটার উত্তর দেয়া কঠিন। তবে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকলে সেটাকে সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে- শ্রমবণ্টন, সামাজিক বিন্যাস, কেন্দ্রীয় শাসনভার, নির্দিষ্ট এলাকা।

যাইহোক, সভ্যতার বিকাশ জ্ঞানচর্চাকে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক রূপে আনার বেলায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার বিকাশের সাথে সবকিছুর হিসাব-নিকাশ রাখার প্রয়োজন হয়, ক্যালেন্ডার, লেখালেখি প্রভৃতির প্রচলন হতে থাকে।

আমরা ইতিহাসের সূচনা করি সাধারণত প্রায় ৫ হাজার বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজারের আশেপাশের সময় থেকে। এর কারণ সেই সময়ে মানুষ লিখনপদ্ধতি আবিষ্কার করে, লিখিত আকারে অতীতকে ধরে রাখতে শুরু করে। যার অগ্রদূতদের মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা ও মিশরীয় সভ্যতার নাম আসবে এবং পর্যায়ক্রমে তা আরো বিকশিত হয়েছে।

এই সব কথা কেন? কারণ আমরা আমাদের পড়াশোনার সুবিধার্থে বিষয়গুলোকে আলাদা করে নিলেও যখন আমরা আরো সামনের দিকে আগাবো, তখন বুঝবো এই সবকিছু একই গল্পের ভিন্ন ভিন্ন কিছু খন্ডাংশ মাত্র। মানবজাতির লক্ষ বছরের পদচারণা যে গল্প পর্যন্ত আমাদের নিয়ে এসেছে।