পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতির মধ্যে কিছু আবিষ্কার এমন ছিলো, যা আমাদের সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আবিষ্কারের পর তা নতুন একটি দিগন্ত খুলে দিয়েছে- যাকে আমরা বলি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান বা মডার্ন ফিজিক্স। অন্যদিকে তার আগ পর্যন্ত আমরা যেভাবে চিন্তা করতাম, তার আলোকে পদার্থবিজ্ঞানের যে ধারা তা হলো চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান বা ক্লাসিকাল ফিজিক্স।

তাহলে আমরা পদার্থবিজ্ঞানকে দুটো ধারাতে ভাগ করতে পারি-

  • চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান (ক্লাসিকাল ফিজিক্স)
  • আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান (মডার্ন ফিজিক্স)

চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান থেকে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান

আমাদের প্রতিদিনের পর্যবেক্ষণে আমরা যা দেখি তার আলোকে প্রকৃতির কিছু নিয়মকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিই। সত্যি বলতে আমরা অনেক সময় ভাবনার দরকারও মনে করি না। যেমন মাধ্যাকর্ষণ বল নিয়ে পড়ার আগে সবকিছু নিচের দিকে পড়ে কেন এই প্রশ্নটা হয়ত আমাদের অনেকের ভাবনাতে আসেনি। একইভাবে সময় যে সবার জন্য সমান আচরণ না-ও করতে পারে, কিংবা শক্তির যে একটা সর্বনিম্ন পরিমাণ থাকতে পারে- এরকম ভাবনাগুলো ততদিন পর্যন্ত ভাবনার দরকার হয়নি যতদিন পর্যন্ত প্রকৃতির রহস্যময় আচরণ আমাদেরকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেনি।

চৌদ্দ থেকে ষোড়শ শতকের দিকটাকে অনেকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশের সময় হিসেবে চিহ্নিত করেন, ইউরোপের ইতিহাসে এই সময়টাকে ইউরোপীয় রেঁনেসা বা নবজাগরণের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের দিকে কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, ফ্রান্সিস বেকন, কেপলার, নিউটন প্রমুখের অবদানের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানচর্চার নতুন একটা স্রোত তৈরি হয়, যাকে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব বলা যেতে পারে।

আলোর রহস্য ও আপেক্ষিকতার তত্ত্ব

উনিশ শতক পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানের যে ধারা চর্চা হয়েছে তাকে ক্লাসিকাল বা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু কিছু সমস্যা দেখা দিলো তারপর। যেমন- আলো কণা না তরঙ্গ এটা নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষার আলোকে বিভিন্ন মত দিয়েছেন অনেকে। বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল আলোকে তাড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তো তরঙ্গ চলাচলের জন্য একটা মাধ্যম প্রয়োজন, ধারণা করা হলো আলো চলাচলের জন্য কোন একটা মাধ্যম আছে, যার একটা নাম দেয়া হলো ইথার। এখন অনেকেই ইথার মাধ্যমের অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। ১৮৮৭ সালে মাইকেলসন-মোরলি একটা পরীক্ষা করলেন পৃথিবী আর আলো চলাচলের মাধ্যম ইথারের আপেক্ষিক বেগ বের করার। কিন্তু এই পরীক্ষার যে ফলাফল আসলো, তা ছিলো অভূতপূর্ব। ইথারের কোন অস্তিত্বের চিহ্ন পাওয়া গেলো না। এবং দেখা গেলো পৃথিবীর বেগ আলোর বেগকে মোটেও প্রভাবিত করছে না।

তো আমরা চিন্তা করি যখন আমরা চলন্ত ট্রেনে থাকি, তখন মনে হয় আশেপাশের গাছগুলো পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে। একই ট্রেনের সিটে বসে থাকা দুজনের কাছে পরস্পরকে স্থির মনে হবে। কিন্তু ট্রেনের বাইরে থাকা একজন তাদেরকে ট্রেনের সাথে গতিশীল দেখবে। মানে আমাদের স্বাভাবিক পর্যবেক্ষণ বলছে একজনের বেগের সাপেক্ষে নির্ভর করে অন্য কিছুর বেগকে সে কীভাবে দেখবে। কিন্তু আলো যেন এই কথাটা মানতে চাইছে না। কীভাবে এর ব্যাখ্যা করা যায়? বড় কিছু একটা মানুষ মিস করে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন চিন্তা করলেন সম্পূর্ণ নতুনভাবে। আচ্ছা, আমরা স্থান আর সময়কে পরম ধরে নিয়েছি। সবার জন্য সময়কে সমান ভাবি। এমন কি হতে পারে, সময় আসলে এভাবে কাজ করে না?

আইনস্টাইন নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন। তিনি দুটো নতুন স্বীকার্যের সাহায্যে প্রকৃতির রহস্যকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন। এটা ছিলো আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব। দ্বিতীয় স্বীকার্যতে তিনি বললেন সময় পরম এভাবে চিন্তা না করে আমরা চিন্তা করব যে আলোর বেগ পরম। অর্থাৎ, গতিশীল বস্তুর জন্য সময় এমনভাবে পরিবর্তন হয় যেন আলোর বেগ তার পর্যবেক্ষণে একইরকম মনে হয়।

এখানে আইনস্টাইন থামলেন না। ১৯০৭ সাল থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে বিকাশ করলেন আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব। সময় ও স্থানকে পরস্পরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে স্পেস-টাইম হিসেবে ব্যাখ্যা করলেন। গ্রাভিটিকে ব্যাখ্যা দিলেন সম্পূর্ণ নতুন ভাবে। যেখানে স্পেস-টাইমের বক্রতার ধারণা নিয়ে আসা হলো।

কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স

আদর্শ কৃষ্ণবস্তু হলো এমন কিছু যা এর ওপর পড়া সকল আলো (বা তাড়িৎচৌম্বক তড়ঙ্গ) শোষণ করে নেয় এবং এর ফলে এতে শক্তি সঞ্চিত হয় এবং কৃষ্ণবস্তুর তাপমাত্রা অনুযায়ী এটা শক্তি বিকিরণ করে। এই ঘটনাকে বলা হয় কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ (Black body radiation)।

ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান অনুযায়ী তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত ক্ষুদ্র হবে, তার জন্য এই কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের তীব্রতা বাধাহীনভাবে তত বাড়তে থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমতে থাকলে তাপমাত্রা অনুযায়ী তীব্রতার বিকিরণের একটা সর্বোচ্চ সীমা দেখা যায়, এরপর আবার কমতে থাকে।

ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞান আবারো একটা ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারছে না। ম্যাক্স প্লাঙ্ক সমাধান করলেন এভাবে, শক্তিকে আমরা যদি অবচ্ছিন্ন না ভেবে বিচ্ছিন্ন গুচ্ছ (কোয়ান্টা) আকারে নির্গত হয় এভাবে চিন্তা করি, তাহলে আমাদের পর্যবেক্ষণগুলোর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। বলা যায় ১৯০১ সালে ম্যাক্স প্লাঙ্কের কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের সূত্রের মাধ্যমে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূচনা।

প্লাঙ্কের সূত্র আলোর তরঙ্গতত্ত্ব নিয়েও নতুনভাবে চিন্তার অবকাশ দিলো। বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছিলো আলো কখনো তরঙ্গের মত আচরণ করলেও কখনো কণার মত আচরণ করে। ডি-ব্রগলি একই ব্যাপার দেখলেন ইলেকট্রনে। ইলেকট্রনকে আমরা কণা হিসেবে জানতাম, অথচ এরও দেখা যাচ্ছে তরঙ্গ ধর্ম আছে। তিনি কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা (Wave–particle duality) ধারণা দিয়ে প্রস্তাব করলেন ইলেকট্রন এবং সব বস্তুরই তরঙ্গ ধর্ম আছে।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সূচনা

এই যে আবিষ্কারগুলো, প্রকৃতি নিয়ে আমাদের এতদিনের বোঝাপড়াকে পুরোপুরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো এরা। স্থান আর সময় পরম না, শক্তি অবিচ্ছিন্ন না, বস্তুকণা ঠিক ‘কণা’ না- আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স পদার্থবিজ্ঞানের শুধু বড় দুটো আবিষ্কার বললে ভুল হবে, পুরো বিশ্বজগৎকে নিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে এই তত্ত্বগুলো। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলোকে লিখিয়েছে নতুনভাবে।

এর আলোকে পদার্থবিজ্ঞানের যে ধারা গড়ে উঠেছে, তাকেই আমরা বলি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান বা মডার্ন ফিজিক্স। আর অন্য ধারাটি যা আগে থেকেই চলে আসছে তা হলো চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান বা ক্লাসিকাল ফিজিক্স। ক্লাসিকাল ফিজিক্স কিন্তু অকার্যকর হয়ে পড়েনি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের আগমনে। আলোর কাছাকাছি বেগ বা অতিক্ষুদ্র কণা নিয়ে কাজ করতে যখন আমাদের আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ধারণার দিকে যেতে হয়, দৈনন্দিন অধিকাংশ ঘটনায় আমরা এত বেশি বেগ বা এত ক্ষুদ্র বস্তু নিয়ে চিন্তা করি না। ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞান তার ব্যাখ্যা দিতে খুবই সক্ষম।

আবার আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান যে পারফেক্ট এমনও না। ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি, বিগ ব্যাঙের উৎপত্তি, ইউনিভার্সাল কন্সট্যান্ট অনেক রহস্য রয়ে গেছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কাছে। কে জানে, হয়ত এরই কোনটা আমাদের চিন্তার জগতকে নতুন করে সাজানোর মত কোন যুগান্তকারী ভাবনা এনে দিবে!

যাইহোক, আমরা পদার্থবিজ্ঞানের দিকে ফোকাস করলেও এর প্রভাব প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সব শাখাতে বিস্তৃত। রসায়নের অনেক বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে পেরেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রি নামে বিস্তৃত একটি শাখা গড়ে উঠেছে। জীবদেহের বিভিন্ন ঘটনা এবং সালোকসংশ্লেষণ, ডিএনএ মিউটেশনসহ বিভিন্ন ঘটনাকে আরো গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স।


চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান (Classical Physics) এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ:

  • বলবিজ্ঞান
  • শব্দবিজ্ঞান
  • তাপ এবং তাপগতি বিজ্ঞান
  • বিদ্যুৎ ও চৌম্বক বিজ্ঞান
  • আলোকবিজ্ঞান

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান (Modern Physics) এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ:

  • আণবিক ও পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান (Molecular and Atomic Physics)
  • নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান
  • কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান (Solid State Physics)
  • পার্টিকেল ফিজিক্স