একক, এককের বিভিন্ন পদ্ধতি ও উপসর্গ
একক
রাশি পরিমাপ করতে অবশ্যই একক (Unit) প্রয়োজন হয়। যেমন ধরা যাক তুমি যদি বলো আমার কাছে ৫ আপেল আছে, তাহলে এর কোন অর্থ হয় না, এতে বোঝা যায় না তোমার কাছে আসলে কতখানি আপেল আছে। কিন্তু তুমি যদি বলো আমার কাছে ৫ পাউন্ড আপেল আছে বা ৫ কেজি আপেল আছে তখন আর কোন দুর্বোধ্যতা থাকে না। এই পাউন্ড বা কেজি হলো একক।
তাহলে একক কী? একক হলো একটা আদর্শ মান, যার সাথে তুলনা করে আমরা পরিমাপ করতে পারি। মানে কিনা পাঁচ কেজি অর্থ হলো এক কেজি যতটা তার পাঁচ গুণ ভর। একইভাবে আমি ২ কিলোমিটার হেঁটেছি অর্থ হলো ১ কিলোমিটারের ২ গুণ বা ১ মিটারের ২০০০ গুণ হেঁটেছি।
মৌলিক রাশির একককে মৌলিক একক ও লদ্ধ রাশির একককে লদ্ধ একক বলে। একই রাশির বিভিন্নরকম এককে মাপা যেতে পারে। যেমন দৈর্ঘ্যকে মিটার, গজ, ফুট প্রভৃতি এককে আমরা মেপে থাকি, আবার দৈনন্দিন কাজে অনেক সময় হাত দিয়েই মেপে ফেলি, এখানে হাতও কিন্তু একরকম একক।
SI একক ও এককের অন্য কিছু পদ্ধতি
এককের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। যেমন ছোটবেলায় পাড়ায় ফুটবল খেলায় গোলপোস্টের দৈর্ঘ্য ঠিক করতে আমরা পা দিয়ে মাপতাম। এক্ষেত্রে পায়ের দৈর্ঘ্য হলো দৈর্ঘ্যের একক। তবে এরকম এককের পদ্ধতি অবশ্যই সবখানে ব্যবহারযোগ্য হবে না। আবার নানারকম এককের ব্যবহার অনেকসময়ই সমস্যাপূর্ণ হতে পারে, এক অঞ্চলের ব্যবহৃত একক অন্য অঞ্চলে বোধগম্য না হতে পারে।
এজন্য মৌলিক রাশিগুলোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে আদর্শ কিছু একককে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মৌলিক রাশিগুলোর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এককগুলোকে SI একক বলে। SI বলতে বোঝায় International System of Unit (এককের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি)। ফরাসি ভাষায় Système International (d’Unités) থেকে SI এসেছে। মৌলিক SI এককগুলোর ভিত্তিতে আরো যৌগিক SI একক পাওয়া যায়।
SI পদ্ধতিতে মৌলিক এককগুলো নিচের ছকে দেখানো হলো:
| রাশি (Quantity) | একক (Unit) | প্রতীক (Symbol) |
|---|---|---|
| সময় (time) | সেকেন্ড (second) | s |
| দৈর্ঘ্য (length) | মিটার (meter) | m |
| ভর (mass) | কিলোগ্রাম (kilogram) | kg |
| বিদ্যুৎ (electric current) | অ্যাম্পিয়ার (ampere) | A |
| তাপমাত্রা (temperature) | কেলভিন (kelvin) | K |
| পদার্থের পরিমাণ (amount of substance) | মোল (mole) | mol |
| দীপন তীব্রতা (luminous intensity) | ক্যান্ডেলা (candela) | cd |
SI এককের বাইরে এককের আরো কিছু পদ্ধতি প্রচলিত আছে। যেমন-
MKS পদ্ধতি: দৈর্ঘ্যের একক মিটার (m), তাপমাত্রার একক কেলভিন (K), সময়ের একক সেকেন্ড (s)
CGS পদ্ধতি: দৈর্ঘ্যের একক সেন্টিমিটার (cm), ভরের একক গ্রাম (g), সময়ের একক সেকেন্ড (s)
FPS পদ্ধতি: দৈর্ঘ্যের একক ফুট (ft), ভরের একক পাউন্ড (lb), সময়ের একক সেকেন্ড (s)।
MKS পদ্ধতির সাথে SI পদ্ধতির কিন্তু একটু পার্থক্য আছে। MKS পদ্ধতিতে এই তিনটি একক আছে, অন্যদিকে SI পদ্ধতিতে মৌলিক ৭টি রাশিরই সুসংজ্ঞায়িত একক আছে। আরেকটা মজার জিনিস এখানে, পাউন্ডকে lb দ্বারা প্রকাশ করা হয়, এটা আসলে একটা রোমান একক থেকে এসেছিলো, যার নাম লিব্রা (libra), এজন্য এরকম।
উপসর্গ বা গুণিতক বা prefix
একটা টেবিলের দৈর্ঘ্য ১ মিটার, এটা বলতে, লিখতে বা বুঝতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু বগুড়া থেকে ঢাকার দূরত্ব বলার বেলায় ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ৫০০ মিটার এভাবে বলাটা মোটেও প্রায়োগিক নয়, বরং আমরা এভাবে বলি যে ১৮৫.৫ কিলোমিটার। আবার মানুষের চুলের ব্যাস ০.০০০০৭৫ মিটার বলার থেকে ৭৫ মাইক্রোমিটার বলাটা অনেক সুবিধাজনক।
এরকম প্রয়োজনে SI এককর সাথে বিভিন্ন গুণিতক বা উপসর্গ ব্যবহার হয়। যেমন 1 km মানে 1 × 10³ m। আমার মতে নিচের চার্টটা তোমাদের মনে রাখা উচিৎ, বিভিন্ন সময়ে এককের সাথে উপসর্গগুলোর ব্যবহার তোমরা দেখবে। এখানে এটা খেয়াল রেখো কিলো পর্যন্ত সব উপসর্গ ছোট হাতের অক্ষরে এবং মেগা থেকে পরবর্তীগুলো বড় হাতের অক্ষরে লেখা হয়।
| ডেকা | da | 10¹ |
| হেক্টো | h | 10² |
| কিলো | k | 10³ |
| মেগা | M | 10⁶ |
| গিগা | G | 10⁹ |
| টেরা | T | 10¹² |
| পেটা | P | 10¹⁵ |
| এক্সা | E | 10¹⁸ |
| ডেসি | d | 10⁻¹ |
| সেন্টি | c | 10⁻² |
| মিলি | m | 10⁻³ |
| মাইক্রো | μ | 10⁻⁶ |
| ন্যানো | n | 10⁻⁹ |
| পিকো | p | 10⁻¹² |
| ফেমটো | f | 10⁻¹⁵ |
| অ্যাটো | a | 10⁻¹⁸ |
একটা ফান ফ্যাক্ট এখানে- কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইসের ক্ষেত্রে আমরা যখন কিলো, মেগা, গিগা বা টেরা ব্যবহার করি, তখন কিন্তু আমরা একটা থেকে অন্যটা 10³ বা 1000 গুণ না নিয়ে 1024 গুণ নিই। এর কারণ হলো এই ডিভাইসগগুলো বাইনারি বা ২ ভিত্তিক পদ্ধতিতে কাজ করে, তাই ২ এর ঘাত এরকম সংখ্যার ব্যবহার এখানে উপযুক্ত। 2¹⁰ বা 1024, 1000 এর বেশ কাছাকাছি বলে এর এখানে 1024 ব্যবহার হয়।
পরিশিষ্ট: SI এককগুলোর সংজ্ঞা
1 kg বলতে আমরা কতটুকু বুঝবো? পরিমাণটা নির্দিষ্ট করা দরকার। আর তার জন্য 1 kg এর একটা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। তো আগে ফ্রান্সে সংরক্ষিত প্লাটিনাম ইরিডিয়ামে তৈরি একটি সিলিন্ডারের ভরকে আদর্শ 1 kg ধরা হত। এরকমভাবে এককের সংজ্ঞা দেয়াতে বেশ সমস্যা আছে। পৃথিবীর দূরবর্তী কোন গবেষণাগারে যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে তা পাওয়া মুশকিল হবে। আবার এরকম কোন জিনিস যেকোনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
২০১৯ সাল থেকে ৭টি বিশ্বজনীন ধ্রুবক ব্যবহার করে সবগুলো SI একককে সংজ্ঞা দেয়া হয়। বর্তমান সংজ্ঞাগুলো বোঝার জন্য ধ্রুবকগুলোর ধারণাসহ কিছু পূর্বজ্ঞান প্রয়োজন। তা এসএসসি পর্যায়ের জন্য উপযুক্ত নয়। নিচের সংজ্ঞাগুলো বোঝা বা মুখস্থ করা কোনটারই প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র কৌতুহল কাজ করলে সেজন্য দিয়ে রাখা।
সেকেন্ড: সিজিয়াম-১৩৩ পরমাণুর সর্বনিম্ন শক্তিস্তরের অতিসূক্ষ্ম দুটি লেভেলের মধ্যে ট্রানজিশনের কারণে ৯,১৯,২৬,৩১,৭৭০টি বিকিরণ সম্পন্ন হতে যে পরিমাণ সময় লাগে।
মিটার: শূন্যস্থানে আলো প্রতি সেকেন্ডের ২৯,৯৭,৯২,৪৫৮ ভাগের এক ভাগ সময়ে যে দূরত্ব অতিক্রম করে।
কিলোগ্রাম: কিলোগ্রামের মান এমন হবে যেন সেকেন্ড ও মিটারের ওপরের সংজ্ঞা ব্যবহার করে প্লাঙ্কের ধ্রুবকের মান এক্সাক্টলি ৬.৬২৬০৭০১৫×১০⁻³⁴ kg m² s⁻¹ পাওয়া যায়।
অ্যাম্পিয়ার: প্রতি সেকেন্ডে মৌলিক চার্জ অর্থাৎ একটি প্রোটনের চার্জের ঠিক ১/১.৬০২১৭৬৬৩৪ x ১০⁻¹⁹ গুণ চার্জের প্রবাহ।
কেলভিন: কেলভিনের মান এমন হবে যেন কিলোগ্রাম, মিটার ও সেকেন্ডের সংজ্ঞা ঠিক রেখে বোল্টজম্যান ধ্রুবকের সাংখ্যিক মান এক্সাক্টলি ১.৩৮০৬৪৯ x ১০⁻²³ J K⁻¹ হয়।
মোল: ঠিক ৬.০২২১৪০৭৬×১০²³ সংখ্যক পরমাণু, অণু, আয়ন, ইলেকট্রন অথবা অন্যান্য মৌলিক সত্ত্বা মিলে যেটুকু পরিমাণ পদার্থ গঠন করে।
ক্যান্ডেলা: কোন নির্দিষ্ট দিকে প্রতি ঘনকোণে ১/৬৮৩ watt ঔজ্জল্যের তীব্রতা আছে এমন উৎস থেকে ৫.৪×১০¹⁴ Hz কম্পাঙ্কের একবর্ণী আলো বিকিরণ হলে যে দীপন তীব্রতা পাওয়া যায়। watt = J s⁻¹ = kg m² s⁻³ এবং Hz = s⁻¹।
বর্তমান সংজ্ঞাগুলো এজন্য দেয়া হয়েছে যেন প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো থেকে একদম সূক্ষ্মভাবে এককগুলোর মান পাওয়া যায়। আমাদের জন্য শুধু এটা বোঝা যথেষ্ট যে সেকেন্ড, মিটার, কিলোগ্রাম বলতে মোটামুটি কতটুকু বোঝায়- এবং এটা আমরা ইতোমধ্যে জানি। এছাড়া আমরা সেলসিয়াস স্কেলের সাথে পরিচিত, প্রতি কেলভিন প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াসের সমান।
রেফারেন্স: উইকিপিডিয়া - International System of Units