চিন্তা করা, কৌতুহলী হওয়া ও অজানাকে জানার চেষ্টা করা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। মানুষ বিভিন্নভাবে তার কৌতুহলকে নিবারণের চেষ্টা করেছে। কখনো পৌরাণিক কাহিনীতে উত্তর খুঁজেছে, কখনো অতীন্দ্রিয় কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আছে, যেখানে সময়ের সাথে পর্যায়ক্রমে পৌঁছেছি আমরা।

আমাদের পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বইগুলোতে এই ক্রমবিকাশ নিয়ে কিছু আলোচনা থাকলেও দুঃখজনকভাবে সেখানে জাফর ইকবালীয় একটা প্রভাব আছে- বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার বদলে কিছু নির্দিষ্ট ধারণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন বিজ্ঞান ও ধর্মের সংঘাতের একপেশে উপস্থাপন ও কিছু ভাষাগত কারসাজি। ইতিহাস পড়ার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে ইতিহাসে অনেক কিছু ঘটেছে যা আমাদের নিজ নিজ আদর্শ ও বিশ্বাসের দিক থেকে বিব্রতকর হতে পারে, কিন্তু তারপরও যেটা ঘটেছে, সেটা বদলাবে না। সেই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রে অবিকৃত অবস্থায় থাকে না এবং অনেক সময়ই ইচ্ছাকৃতভাবেই ইতিহাসের বিকৃত বা উদ্দেশ্যমূলক উপস্থাপনের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়।

সভ্যতার উত্থানের আগে এবং বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্ন মাত্রায় কাজ হয়েছে যেগুলোকে আজকের বিচারে চিকিৎসাবিদ্যা, গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতির অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রাচীন বিভিন্ন সভ্যতা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শিতা দেখিয়েছে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উৎপত্তি আর বিকাশের গল্পগুলো আমরা আলাদা আলাদাভাবে পড়তে পারি। কিন্তু সবগুলো খন্ডাংশ এক করলে আজকের বিজ্ঞান পর্যন্ত আসার চিত্রটা আমাদের সামনে উঠে আসবে।

জ্যোতির্বিদ্যাকে অনেকে বিজ্ঞানের প্রাচীনতম শাখা হিসেবে দেখেন। অযুত বছরের প্রাচীন নিদর্শনে আমরা খুঁজে পাই তখনও মানুষ চাঁদ-সূর্যের অবস্থান দেখে দিন-মাস এমনকি বছরের হিসেব রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তারাদের প্রতি মানুুষের আগ্রহ আরেকটা কারণেও ছিলো, তারাদের গতিপথের সাথে প্রকৃতির বদলে যাওয়া যেমন তারা দেখেছে, তেমনই মানুষের ভাগ্যকেও খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করেছে তারাদের মাঝে। আজকের দিনে জ্যোতির্বিদ্যা আর জ্যোতিষবিদ্যাকে দুই মেরুতে দেখা হলেও এদের শুরুটা অনেকটা একই জায়গাতে। একইভাবে রসায়নের গবেষনায় মানুষের অনুপ্রেরণা ছিলো অমরত্বের সন্ধান ও ধাতুকে স্বর্ণে রূপান্তরের বাসনা। যা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পদার্থের ক্রিয়া-বিক্রিয়া ও রূপান্তর নিয়ে গভীর অনুসন্ধানের দিকে নিয়ে যায়।

তবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাসের মূল আলোচনা আমরা শুরু করব প্রায় ছয়শো খ্রিস্টপূর্বের দিকের গ্রিক সভ্যতা থেকে, অনেকেই যে সময়টাকে প্রাকৃতিক দর্শনের সূচনাকাল হিসেবে দেখবেন।

থেলিস এবং প্রাকৃতিক দর্শনের সূচনা

গ্রিসে তখন প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনার জন্য পৌরাণিক ব্যাখ্যার প্রচলন ছিলো। যেমন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তকে ব্যাখ্যা করা হতো দেবতা হেলিওসের তার রথে করে প্রতিদিন পূর্বের ওসেনাস নদী থেকে যাত্রা করে পশ্চিমে পৃথিবীর নিচে পাড়ি দেয়া।

থেলিস (খ্রি:পূ: ৬২৪-৫৮৬) এই ধরণের ব্যাখ্যাতে সন্তুষ্ট থাকতে চাইলেন না। তিনি প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোকে প্রকৃতির নিয়মের আলোকেই যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে আনতে চাইলেন। থেলিসের কাজগুলো উঠে এসেছে অ্যারিস্টটলসহ পরবর্তী গ্রিক দার্শনিকদের লেখার মধ্যে। সেসব থেকে জানা যায় থেলিস পানিকে ব্যাখ্যা করেছেন সবকিছুর মৌলিক ভিত্তি হিসেবে (Water as the arche)। থেলিসের মত ছিলো সবকিছু পানি থেকে আসে, এবং সবশেষে পানিতে পরিণত হয়, অন্যভাবে বললে সবকিছু পানির পরিবর্তিত রূপ। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যাসহ বিভিন্ন শাখায় থেলিসের বিচরণ ছিলো। ঐতিহাসিক হেরোডোটাস (খ্রি:পূ: ৪৮৪-৪২৫) বিবরণ থেকে জানা যায় থেলিস এক যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। যদিও অনেকে এই বিবরণে অতিরঞ্জন থাকার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন।

অ্যারিস্টটলের বিবরণ থেকে জানা যায় থেলিস মনে করতেন “all things are full of gods”, সবকিছুই ঈশ্বর বা দৈবশক্তিতে পূর্ণ। যেমন লোডস্টোন লোহাকে আকর্ষণ করতে পারে কারণ তার মধ্যে একরকম প্রাণশক্তি (soul) আছে। সাইসেরোর বিবরণ অনুযায়ী থেলিসের মতামত ছিলো সবকিছুর মৌলিক ভিত্তিতে আছে পানি, আর ঈশ্বর হলেন সেই মন যা পানি থেকে সবকিছুকে আকৃতি দিয়েছেন ও সৃষ্টি করেছেন।

অ্যারিস্টটল (খ্রি:পূ ৩৮৪-৩২২) থেলিসকে প্রথম প্রাকৃতিক দার্শনিক হিসেবে অবহিত করেন। পরবর্তীতে অষ্টাদশ শতকের দিকের ইতিহাসবিদদের কাছেও থেলিসের এই পরিচয় প্রাধান্য পায়।

আরো জানতে: উইকিপিডিয়া - Thales of Miletus

গ্রিসের প্রাকৃতিক দর্শন

প্রাকৃতিক দর্শনকে বলা যেতে পারে অতিপ্রাকৃত কোন ব্যাখ্যাতে না যেয়ে প্রকৃতির নিয়মের ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে থেকে প্রকৃতি ও বস্তুজগতকে অধ্যয়ন। বিস্তৃত অর্থে, দর্শন হলো বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করা- যা নৈতিকতা, রাজনীতি, যুক্তিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব বিভিন্ন বিষয়ে হতে পারে। প্রাকৃতিক দর্শন তার একটা ধারা যেখানে প্রকৃতির নিয়মের আলোকে প্রকৃতির কার্যকারণ বোঝার চেষ্টা করা হয়।

বর্তমান বিজ্ঞান যখন মৌলিকভাবে পরীক্ষণ ও প্রমাণনির্ভর, তখন প্রাকৃতিক দর্শন অনেকাংশে ছিলো চিন্তা ও যুক্তিনির্ভর- পার্থক্যটা এখানে। বিজ্ঞানের একটা আদিরূপ হিসেবে আমরা একে দেখতে পারি। পর্যায়ক্রমে এটা আরো বিকাশ পাবে এবং বর্তমানের দিকে রূপ নিবে।

গ্রিসের জ্ঞানচর্চায় পরবর্তীকালে বিভিন্নজন প্রাকৃতিক দর্শনের এই ধারা অব্যহত থেকেছে। দার্শনিক ও বহুবিদ্যাবিশারদ পিথাগোরাস (খ্রি:পূ: ৫২৭-৪৯৭) গণিত, জ্যামিতি, রাজনীতি, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা, সংগীতসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা রেখেছেন। গণিত ও জ্যামিতিতে তার অবদান সুবিখ্যাত। পৃথিবী গোলাকৃতি, এই ধারণা দেয়া প্রথমদের মধ্যে একজন তিনি। কম্পমান তার নিয়ে পিথাগোরাসের কাজ বাদ্যযন্ত্রের অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

তবে পিথাগোরাসের নিজের কোন লেখা কালের বিবর্তনে টিকে থাকেনি। যেকারণে পিথাগোরাসের নিজের কাজ কোনগুলো এবং সমসাময়িক অন্যান্য বা পিথাগোরাসের শিষ্যদের কাজ কোনগুলো তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্য ধোঁয়াশা আছে। তবে বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে পিথাগোরাস গুরুত্বপূর্ণ একজন এবং তার চিন্তাধারা ও বিস্তৃত বিচরণ বিভিন্নভাবে পরবর্তীদের প্রভাবিত করেছে এটুকু বলাই যায়।

(অসম্পূর্ণ)