প্রথম অধ্যায় (রসায়নের ধারণা) –পরীক্ষাগার ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে সতর্কতা

This entry is part 6 of 11 in the series এসএসসি রসায়ন

১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট ডার্টমাউথ কলেজের অধ্যাপক ড. কারেন ওয়েটারহ্যান গবেষণার কাজে পারদের বিষাক্ত যৌগ ডাইমিথাইলমার্কারি ব্যবহার করছিলেন। এক-দুই ফোঁটা ডাইমিথাইলমার্কারি তার গ্লাভসে পড়ে। গ্লাভসকে যথেষ্ট মনে করে তিনি সেই গ্লাভস পড়েই আরো কিছুক্ষণ কাজ চালিয়ে যান। তৎক্ষণাৎ কোন প্রভাব দেখা যায় না। কিন্তু তিন মাসের মধ্যে তার দেহে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে থাকে। পাঁচ মাস পর পারদ বিষাক্ততা ধরা পরে। এর দু’সপ্তাহের মধ্যে তিনি কোমায় চলে যান, এবং কখনো আর সুস্থ হয়ে উঠেননি। ১৯৯৭ সালের ৮ জুন তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

ড. কারেন সেফটি গগলস, গ্লাভস ব্যবহারসহ পূর্বসতর্কতা নিয়েছিলেন। কিন্তু তখনকার ল্যাটেক্স গ্লাভস ডাইমিথাইলমার্কারি আটকানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো না। ড. কারেনের দুঃখজনক মৃত্যু গ্লাভস ও গবেষণাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখে গেছে। এধরণের ঝুঁকিপূর্ণ গবেষণার জন্য আরো উন্নত গ্লাভস আবিষ্কার হয়েছে। বর্তমানে যেকোন প্রয়োজনে ডাইমিথাইলমার্কারি ব্যবহার শক্তভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। (সোর্স)

রসায়ন নিয়ে কাজ করার সময় ছোট্ট ভুলের মাশুল দিতে হতে পারে অনেক বড়। ছোট্ট অসতর্কতা রসায়ন পরীক্ষাগারে দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এরকম ঘটনা পাওয়া যাবে অনেক। সে ঘটনাগুলো থেকে আমরা সতর্ক হওয়ারও চেষ্টা করেছি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোর দিয়েছি।

রসায়ন পরীক্ষাগারে সতর্কতা ও সচেতনতা

রসায়ন নিয়ে কাজ করার জায়গা রসায়ন পরীক্ষাগার। পরীক্ষাগার বা গবেষণাগার হলো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নীরিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিশেষায়িত কক্ষ। রসায়ন পরীক্ষাগারে পরীক্ষণের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক থাকে।

রসায়ন পরীক্ষাগারে থাকা বেশিরভাগ রাসায়নিক দ্রব্য বিভিন্ন মাত্রায় মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে থাকে। এবং একটু অসতর্ক হলেই দুর্ঘটনা ঘটা এখানে খুবই সহজ।

বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য আছে বিস্ফোরক জাতীয়, কোনটি দাহ্য অর্থাৎ সহজে আগুন ধরে যেতে পারে। কোন কোন রাসায়নিক ত্বকে লাগলে বিপজ্জনক হতে পারে, কোনটি বাতাসের সাথে শ্বাসপ্রশ্বাসে মিশে ক্ষতি করতে পারে। আবার সচারচর পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত রাসায়নিকগুলোর সাথে বিক্রিয়া করে না বলে বিভিন্ন পাত্র ও যন্ত্রপাতি কাচের তৈরি হয়।

এজন্য রসায়ন পরীক্ষাগারে দুটি বিষয় প্রয়োজন। প্রথমত সতর্কতা, দ্বিতীয়ত সুরক্ষা ব্যবস্থা।

পরীক্ষাগারে ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা

কীধরণের পরীক্ষণ হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে কতটা এবং কীধরণের সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু যথেষ্ট নিরাপদ পরীক্ষণের ক্ষেত্রেও রসায়ন পরীক্ষাগারে সাধারণ কিছু নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন ত্বক ও পোশাকের সুরক্ষার জন্য ল্যাব কোট বা অ্যাপ্রোন, চোখের সুরক্ষার জন্য সেফটি গগলস ব্যবহার করা উচিৎ। রাসায়নিক দ্রব্যাদি স্থানান্তরের সময় উপযুক্ত ধরণের গ্লাভস ব্যবহার করা উচিৎ। পা ঢেকে থাকে এধরণের জুতা ব্যবহার করা প্রয়োজন।

বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজগুলোতে এই দিকগুলো পরীক্ষাগারে অনুসরণ করা হয় না। এখানে পরিবর্তন প্রয়োজন। এটা ঠিক যে স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে যে পরীক্ষণগুলো করি তাতে খুব বিষাক্ত কিছু নিয়ে বা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কোন পরীক্ষা করা হয় না। তবে সাধারণ সুরক্ষাব্যবস্থাগুলো সবসময়ই নেয়া উচিৎ, অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটনার আগেই।

রাসায়নিক দ্রব্যের লেবেলে ব্যবহৃত সাংকেতিক চিহ্ন পরিচিতি

রাসায়নিক দ্রব্যগুলোর ঝুঁকি চিহ্নিত করতে আগে বিভিন্ন ধরণের নিয়ম ব্যবহার হত। ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘ একে একটি সার্বজনীন নিয়মে আনার চেষ্টা করে, যাকে বলা হয় Globally Harmonized System of Classification and Labelling of Chemicals (GHS)। এক্ষেত্রে রাসায়নিক পদার্থের ঝুঁকি অনুযায়ী পাত্র বা কৌটায় সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। গবেষণাগারে নিরাপদ রসায়নচর্চা করার জন্য এই সাংকেতিক চিহ্নগুলোর পরিচয় ও সাবধানতা সম্পর্কে জেনে রাখা প্রয়োজন।

বিস্ফোরক পদার্থ

  • আঘাত বা আগুন লাগলে বিস্ফোরণ হতে পারে
  • খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হয়
  • উদাহরণ: নাইট্রোগ্লিসারিন, TNT, জৈব পারঅক্সাইড

দাহ্য পদার্থ

  • দ্রুত আগুন ধরে যেতে পারে
  • আগুন থেকে দূরে রাখতে হবে
  • উদাহরণ: অ্যালকোহল, ইথার

বিষাক্ত পদার্থ

  • শরীরে লাগলে, শ্বাস প্রশ্বাস অথবা ক্ষতের মাধমে প্রবেশ করলে বিভিন্ন শারীরিক ক্ষতি হতে পারে
  • অ্যাপ্রন, হ্যান্ড গ্লাভস, সেফটি গগলস, মাস্ক ব্যবহার করতে হবে
  • উদাহরণ: বেনজিন, ক্লোরোবেনজিন, মিথানল

উত্তেজক পদার্থ

  • ত্বক, চোখ, শ্বাসতন্ত্র ইত্যাদির ক্ষতি
  • অ্যাপ্রন, হ্যান্ড গ্লাভস, সেফটি গগলস ব্যবহার করতে হবে
  • উদাহরণ: সিমেন্ট ডাস্ট, লঘু এসিড, ক্ষার, নাইট্রাস অক্সাইড

স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ

  • ত্বকে লাগলে বা শ্বাস প্রশ্বাসে প্রবেশ করলে শরীরের স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিসাধন করে- ক্যানসার রোগ বা শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতিসাধন করতে পারে
  • সতর্কভাবে রাখতে হবে এবং অ্যাপ্রন, হ্যান্ড গ্লাভস, সেফটি গগলস ও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে
  • উদাহরণ: বেনজিন, টলুইন, জাইলিন

তেজষ্ক্রিয় পদার্থ

  • ক্ষতিকারক রশ্মি নির্গত করে যা ক্যানসারসহ মরণব্যধি ও বিকলঙ্গতার কারণ হতে পারে
  • বিশেষ সতর্কতা আবশ্যক
  • উদাহরণ: ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম

পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর

  • উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর
  • যেখানে সেখানে না ফেলে ব্যবহারের পর নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে এবং যথাসম্ভব পুনরুদ্ধার করে ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে
  • উদাহরণ: লেড (সীসা), মার্কারি (পারদ)

ক্ষত সৃষ্টিকারী

  • শরীরে লাগলে ক্ষত সৃষ্টি করে
  • শ্বাস-প্রশ্বাসে গ্রহণ করলে ভেতরের অঙ্গের ক্ষতিসাধন করতে পারে
  • উদাহরণ: হাইড্রোক্লোরিক এসিড, সালফিউরিক এসিড, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডের ঘন দ্রবণ
Series Navigation<< প্রথম অধ্যায় (রসায়নের ধারণা) – রসায়নে গবেষণা প্রক্রিয়াদ্বিতীয় অধ্যায় (পদার্থের অবস্থা) – কণার গতিতত্ত্ব ও পদার্থের ভৌত অবস্থা >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *